এক বৈদ্যুতিক বালকের গল্প
মাইকেল ফ্যারাডে
চিত্র : মাইকেল ফ্যারাডে।
হতদরিদ্র এক পরিবারে জন্ম মাইকেল ফ্যারাডের। স্কুলে পড়ার সুযোগ পাননি। ছোটবেলায় অবশ্য স্কুলে একবার গিয়েছিলেন তিনি। ইংরেজি R শব্দটি উচ্চারণ করতে পারতেন না বলে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয় তাকে। তিনি নিজের নামটিও উচ্চারণ করতেন “মাইকেল ফ্যাওয়াডে”। ইতিহাস স্বাক্ষী যে, তিনি আর কোনোদিন স্কুলে যাননি। এই মানুষটিই বদলে দেন দুনিয়ার রূপ।
তিনি যখন কৈশোরে পা দেন, তখন একটা বই বাঁধাইয়ের দোকানে কাজ পান। দিনের বেলা বই বাঁধাই করতেন, আর রাতে সেগুলো পড়তেন। এভাবেই বিজ্ঞানের জগতে ফ্যারাডের প্রবেশ, বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসার জন্ম।
২১ বছর বয়সটা ফ্যারাডের জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই বছরটাই তার জীবন বদলে দেয়। লন্ডনের রয়্যাল ইন্সটিটিউটে যান তিনি, হামফ্রে ডেভীর বক্তৃতা শুনতে। বক্তৃতা শুনে মুগ্ধতা আরো বেড়ে যায় বিজ্ঞানের প্রতি। হামফ্রে ডেভীর কথাগুলো সুন্দর করে গুছিয়ে লিখে একটা বই আকারে বাঁধাই করেন। ফ্যারাডের কাছে রয়্যাল ইন্সটিটিউট তখন এক স্বপ্নরাজ্য। সেখানে কাজ করার সুযোগ পেলে হাতছাড়া করবেন না তিনি, এমন মনোভাব। বাঁধাইকৃত বইটি তাই পাঠিয়ে দেন হামফ্রে ডেভীর নাম করে রয়্যাল ইন্সটিটিউটে।
এর কিছুদিন পর, ডেভী একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে যেয়ে আহত হন। তার তখন মনে হয় সেই ছেলেটির কথা, যে তার বক্তৃতায় তালি না বাজিয়ে কথাগুলো টুকে নিচ্ছিল, সেই লেখাগুলোকে বই আকারে বাঁধাই করে দিয়েছিল। বিজ্ঞানের প্রতি অপার ভালবাসা লক্ষ্য করেই তিনি ফ্যারাডেকে তার সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন রয়্যাল ইন্সটিটিউটে।
তখনকার সময়ে বিজ্ঞানী ওয়েরস্টেড তার অসাধারণ আবিষ্কারটি সম্পন্ন করেন; তড়িৎবাহী তারের চুম্বকের ন্যায় আচরণ। ডেভীর কাছে সেটা তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার মনে হয়নি, কিন্তু Faraday was on fire. তিনি এটাকে ব্যবহার করে এমন এক যন্ত্র তৈরি করেন, যা এক নতুন যুগের সূচনা করে; এই যুগের সূচনা করে। তিনি তৈরি করেন বৈদ্যুতিক মোটর। হাজার হাজার জিনিসের নাম বলে যেতে পারব, এই বইয়ের পাতা শেষ হয়ে যাবে, তবু উদাহরণের তালিকা শেষ হবে না। কত সময় প্রবাহিত হয়ে গেছে, কিন্তু এখন ভাবলে মনে হয় মুহুর্তেই বদলে গেছে দুনিয়া। সবখানে মোটরের ব্যবহার, যেখানেই কিছু ঘুরছে সেখানেই মোটর। এটাই হলো বিদ্যুৎ থেকে গতিশক্তি পাওয়ার সূচনা।
কিন্তু সহকারীর এরূপ রাতারাতি বিখ্যাত বনে যাওয়া ডেভীর কাছে ভাল লাগেনি। ডেভী ফ্যারাডের কাজ বন্ধ করে দিয়ে পাঠিয়ে দেন কাঁচের কারখানায়। যে কাঁচের ব্যাপারে ফ্যারাডে কিছুই জানতেন না, তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় বেলজিয়াম কাঁচ থেকেও ভালো মানের কাঁচ বানাতে হবে। কাঁচ বানানোতে বিশেষ কিছু করতে পারেননি তিনি। ডেভীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ফ্যারাডে এই কাজ থেকে মুক্তি পান। তখন তিনি হন রয়্যাল ইন্সটিটিউটের নতুন পরিচালক। কাঁচ নিয়ে কাজ করার সময় বাজে মানের যে কাঁচ তৈরি হয়েছিল, সেটা থেকে সামান্য কাঁচ স্মৃতিস্বরূপ রেখে দেন তার ল্যাবে। এই কাঁচটাই পরবর্তীতে আরেকটি নতুন আবিষ্কারের সূচনা করে।
রয়্যাল ইন্সটিটিউটের পরিচালক হিসেবে তিনি তার ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করতে শুরু করেন। আবিষ্কার করেন তড়িৎ-চৌম্বকীয় আবেশ; যা ছাড়া বর্তমান পরিবর্তী প্রবাহের কথা চিন্তাই করা যায় না। তিনি আবিষ্কার করেন, পরিবাহীর তার কুন্ডলীর মাঝ দিয়ে চৌম্বক ফ্লাক্সের পরিবর্তন বিদ্যুৎ তৈরি করে। ওটাই ছিল প্রথম জেনারেটর। এখন জেনারেটরের কতশত রূপ দেখা যায়। বিদ্যুৎ থেকে গতি, গতি থেকে বিদ্যুৎ; শক্তির এরূপ পরিবর্তন দু’টোই ছিল ফ্যারাডের দখলে।
হঠাৎ করে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, বার্ধক্য ঝেঁকে বসে, তার কাছে মনে হয় তিনি সবকিছু যেন ভুলে যাচ্ছেন, কোনো কিছু মনে থাকছে না। তাও তিনি তার সাফল্য চালিয়ে যান। আবিষ্কার করেন চৌম্বক বলরেখা, কাল্পনিক এই বলরেখার কারণেই চুম্বকের আচরণ ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়। বিজ্ঞানের পাতায় যুক্ত হয় ক্ষেত্রতত্ত্ব।
চৌম্বকক্ষেত্র আর তড়িৎক্ষেত্রের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা চিন্তা করে তিনি ভাবেন এই দুইটি অদৃশ্য বস্তুর সাথে কি আরও একটি অদৃশ্য বস্তুর সম্পর্ক থাকা সম্ভব? আলো, আলোকরশ্মির সাথে কি চৌম্বকত্ব আর তড়িৎক্ষেত্রের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে? তিনি একটা এক্সপেরিমেন্ট করলেন। আমরা জানি যে, আলোকরশ্মি চারিদিকে সঞ্চারিত হয়। ফ্যারাডে পোলারাইজার ব্যবহার করে আলোকে আনুভূমিকভাবে সমান্তরাল একক রশ্মিতে পরিণত করেন, তারপর চেষ্টা করেন তড়িৎচৌম্বক বলরেখা ব্যবহার করে আলোকতরঙ্গকে আবারো উল্লম্ব তরঙ্গে পরিবর্তন করা যায় কিনা। লেন্সের অপর পাশে একটি মোমবাতি হলো আলোর উৎস। তড়িৎচৌম্বক বলরেখা দ্বারা সেই পোলারাইজড আলোর ফাংশন পরিবর্তন করা গেলেই কেবল উৎস মোমবাতিটি দেখা যাবে।
কিন্তু কোনো ফল আসলো না। তড়িৎচৌম্বক বলরেখার মধ্য দিয়েই সমান্তরাল আলোকরশ্মি অতিক্রম করতে লাগলো। ফ্যারাডে ভাবলেন, হয়তো বায়ু মাধ্যমে তড়িৎচৌম্বক বলরেখা আলোকরশ্মির উপর প্রভাবিত করতে পারছে না।
শতশত পদার্থ তড়িৎবাহী তারের উপর বসিয়ে চেষ্টা করেন তিনি; তরল, কঠিন, গ্যাস কিছুই বাদ দেননি। একসময় ল্যাবের এক জায়গায় তার নজরে আসে সেই কাঁচটি যেটি তিনি রেখেছিলেন। এনে বসিয়ে দেন তারের উপর। চোখ রাখেন লেন্সে। অপর পাশে রাখা মোমবাতিটি সাথে সাথে দৃশ্যমান হয়ে যায়।
যদি বুঝতে একটু কঠিন মনে হয়, তাহলে চিন্তার কোনো কারণ নেই। ফ্যারাডের এই আবিষ্কারটি বিজ্ঞানীদের বুঝে উঠতে একশো বছরের মতো লেগেছিল।
এটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার ছিল সেটা কখনো বোঝা যাবে না, যদি আমি না বলি যে এটা দিয়েই নতুন এক দরজা খুলে দেয়া হয় আইনস্টাইন আর তার পরবর্তী সকল পদার্থবিদের জন্যে। এখানে আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে ব্যাখ্যা দিলাম না, রেখে দিলাম পাঠক-পাঠিকাদের জন্য। বিজ্ঞানের প্রতি এতটুকু ভালবাসাও যদি থাকে, তাহলে তারাই খুঁজে বের করবে এটা কী জিনিস। অবশ্য বিজ্ঞান শিক্ষানবিশদের ইতিমধ্যে বুঝে যাওয়ার কথা আলোক তরঙ্গ পরিবর্তন করে কি বানানো যেতে পারে।
৪০ বছর বয়সের মধ্যেই তিন বাঘা আবিষ্কার ফ্যারাডের ঝুলিতে; ইলেকট্রিক মোটর, জেনারেটর, ট্রান্সফরমার। এবার ফ্যারাডে কাজ শুরু করেন তড়িৎচৌম্বক বলরেখা নিয়ে। তিনি লৌহ গুড়ো ছড়িয়ে দেখতে পান যে, তড়িৎবাহী তারের চারপাশে অনেকগুলো বৃত্ত তৈরি করে। ফ্যারাডে ভাবেন যে তড়িৎবাহী তারের প্রতি কণার চারপাশেই এমন কতগুলো বৃত্ত রয়েছে, যা হলো তার বলরেখা, এর আয়ত্তে আনা হলে চুম্বকের আচরণ পরিবর্তিত হয়। তিনি এর দ্বারা পৃথিবী যে চুম্বকের ন্যায় আচরণ করে, তার ব্যাখ্যাও দেন।
রয়্যাল ইন্সটিটিউটের অন্যান্য সকল বিজ্ঞানীরা তার আবিষ্কারের কদর করতেন, কিন্তু অদৃশ্য বলরেখার ধারণা তারা মেনে নেয়নি। ব্যাখ্যা শুনিয়ে অভিভূত করতে পারলেও ফ্যারাডে বিজ্ঞানীকুলকে দিতে পারেননি কোনো সূক্ষ্ম গাণিতিক ব্যাখ্যা। গাণিতিক ব্যাখ্যা কীভাবে দিতেন তিনি? তিনি যে কখনো স্কুলেই যাননি। বিজ্ঞানের গাণিতিক তত্ত্বগুলোর উপর একদম দখল ছিল না তার। জীবনে প্রথমবারের মতো তিনি মুষড়ে পড়েন।
ফ্যারাডের কাজের স্বীকৃতি দিতেই যেন জন্ম হলো ম্যাক্সওয়েলের। জেমস্ ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। রাজপরিবারে জন্ম নেয়া এক শিশু, যৌবনে পা দেয়ার আগেই পড়ে শেষ করে ফেললেন তখনকার সময়ে আবিষ্কৃত বিজ্ঞানের সকল ধ্যান-ধারণা। ফ্যারাডের বই হাতে নিয়ে পড়লেন তিনি। অভিভূত হয়ে গেলেন ফ্যারাডের আবিষ্কারে। ইলেকট্রিসিটির উপরে লেখা ফ্যারাডের সব জার্নাল পড়ে ফেললেন তিনি। কিন্তু দেখলেন যে, ফ্যারাডের ব্যাখ্যার সাথে পদার্থবিজ্ঞান আর গণিতের কোনো সম্পর্ক নেই। ফ্যারাডের আবিষ্কার ছিল বৈপ্লবিক, ব্যাখ্যাগুলোও অভিভূতকারী, কিন্তু অভাববোধ করেন পদার্থবিজ্ঞানের গাণিতিক ভাষার। তিনি বুঝতে পারেন তাকে কী করতে হবে।
ম্যাক্সওয়েল ফ্যারাডের সব বই, আর্টিক্যাল খুঁজে নিয়ে পড়লেন। ফ্যারাডের চৌম্বক বলরেখার কথা পড়ে তিনি অবাক হয়ে গেলেন, এমন অদৃশ্য বস্তু কি আসলেই আছে? তিনি শুরু করলেন বলরেখার গাণিতিক ব্যাখ্যা দিতে, সমীকরণরূপে দাঁড় করাতে লাগলেন, যার অভাবে ফ্যারাডে তার অতি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের স্বীকৃতি পাননি।
ম্যাক্সওয়েল গাণিতিক ব্যাখ্যাগুলি বই আকারে বাঁধাই করে নিয়ে গেলেন ফ্যারাডের কাছে। বইটা হাতে পেয়ে ফ্যারাডের মনে পড়ে গেল বহুপুরনো একটি ঘটনা, তিনিও একদিন এভাবে কারও কাছে একটি বই লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন।
ফ্যারাডে দেখলেন যে, ম্যাক্সওয়েল গাণিতিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তড়িৎচৌম্বক বলরেখার একটা সমীকরণ মেলাতে পারছিলেন না। ম্যাক্সওয়েল তখন ছোট্ট এক পরিবর্তন করে দেয়, এতেই সবকিছু মিলে যায়। ফ্যারাডে ধারণা করেছিলেন তড়িৎচৌম্বক বলরেখাগুলো স্থির বৃত্ত তৈরি করে থাকে তড়িৎবাহী পরিবাহীর চারপাশে। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের সংশোধনে সেটি হয়ে যায় এরূপ, বৃত্তাকার বলরেখাগুলো আলোকতরঙ্গের গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানের মাইক্রোফোন, স্পীকার এই তত্ত্বকে ভিত্তি করেই নির্মাণ করা হয়েছে।
ফ্যারাডের গল্প বলা তো শেষ, কিন্তু শেষ হয়নি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। মানুষকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমার প্রিয় বিজ্ঞানী কে? বুঝে না বুঝে উত্তর আসবে, নিউটন, আইনস্টাইন, কেউ কেউ হকিং এর নামও হয়তো নিবে। কিন্তু যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তাদের কোন আবিষ্কারটির জন্য তারা প্রিয়? তখন অনেকেই চুপ করে যাবে।
আমি বিজ্ঞানের প্রতি সবসময় ঋণবোধ করি, বিজ্ঞানীকুলের মাঝে শুধুমাত্র মাইকেল ফ্যারাডের প্রতি ঋণবোধ করি। তিনি জন্মেছেন, অনেক কিছু দেখিয়ে গিয়েছেন, পৃথিবী এগিয়ে যাবে, হয়তো আরও বড় কিছু তৈরি করবে মানুষ, কম্পিউটার-ইন্টারনেট তৈরি করেছে। কেউ কি বলতে পারবে যে কম্পিউটার-ইন্টারনেটের মাঝে ফ্যারাডের কোন আবিষ্কারকে ব্যবহার করা হয়নি? ডেক্সটপ কম্পিউটারের সিপিইউ তে কমপক্ষে দুইটা কুলিং ফ্যান ব্যবহার করা হয়। অন্যান্য আবিষ্কারগুলি না হয় নাই ধরলাম, ফ্যারাডের মোটরকে ব্যবহার করা হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। দুনিয়া আরও এগিয়ে যাবে, কিন্তু মোটর আবিষ্কার করা শেষ হয়ে গেছে সেই উনবিংশ শতাব্দীতেই, স্কুলে না পড়া এক ছেলের হাত ধরে।
মাইকেল ফ্যারাডে কী করে গিয়েছেন আমাদের জন্য সেটা সবাইকে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেয়াটাই ছিল আমার এই লেখার উদ্দেশ্য। আমার ধারণা পাঠক-পাঠিকাদের একটি বার হলেও ভাবাবে যে, মাইকেল
ফ্যারাডে নামের কোনো একজন বিজ্ঞানী ছিলেন, যিনি কখনো স্কুলে যাননি, কিন্তু মানবজাতির জন্য অনেক কিছু করে গিয়েছেন।
একটা কথা বলে শেষ করছি আমি। হামফ্রে ডেভী বেশকিছু মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার করেছিলেন। সোডিয়াম আর ক্যালসিয়াম আবিষ্কারের কৃতিত্ব তারই। কিন্তু বলা হয়ে থাকে যে, ডেভীর সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার ছিল মাইকেল ফ্যারাডে।
কোন মন্তব্য নেই